সুদিন কি দেখে যেতে পারবেন বাবা

বর্ষাকালে খুব ভোরে বাবার সঙ্গে বের হতাম। মাটিয়ান হাওরে আমাদের বাড়ি। সেখান থেকে নৌকা বেয়ে মাছ কিনতে যেতাম বাবা-ছেলে। নৌকা চালানোর সময় খেয়াল করতাম, বাবার চোখেমুখে রাজ্যের ক্লান্তি। তবু শক্ত হাতে বইঠা বেয়ে চলেছেন নিরলস। সারা দিন মাছ বিক্রি করে গভীর রাতে ঘরে ফেরেন। খেয়েদেয়ে বিছানায় গিয়ে ঠিকমতো হয়তো ঘুমাতেও পারেন না, আবার ভোরে বেরিয়ে পড়তে হয়। বাবার এই ক্লান্তি আমার মনে বিষাদের জন্ম দিত।

এ তো গেল বর্ষাকালের কথা। শুকনা মৌসুম জীবন আরও কঠিন। হাঁটা ছাড়া আর বিকল্প নেই। সে সময় মাটিয়ান হাওর থেকে প্রতিদিন ৩০ মাইল দূরের জয় বাংলা বাজারে গিয়ে মাছ বিক্রি করতে হয় বাবাকে। একদিন দেখি, ক্লান্ত শরীরে কাঁধে বোঝা বয়ে যাচ্ছেন। দেখে চোখে পানি চলে এল। এই বয়সেও কীভাবে একাই সংসারের হাল ধরে আছেন। এ যেন ঘাম নয়, শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। তখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি।

আমরা সাত ভাইবোন। তার মধ্যে পাঁচজন পড়াশোনা করতাম। বাবার পক্ষে সবার খরচ বহন করা ছিল প্রায় অসম্ভব। তবু প্রাণপণ চেষ্টা    করতেন যেন আমাদের পড়াশোনায় কোনো  ব্যাঘাত না হয়।

আমিও বাবার কাজে সহযোগিতা করতাম। সুযোগ পেলেই নিজের পড়াশোনার খরচ মেটাতে অন্য কাজে লেগে পড়তাম। কখনো রাজমিস্ত্রিগিরি, কখনো হাওরের ধান রোপণ অথবা রাস্তা মেরামতের কাজ করতাম।

এভাবে রক্তভেজা ঘাম ঝরিয়ে আমাদের মানুষ করেছেন বাবা। আমার বড় ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করে এখন প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করছেন। মেজ ভাই ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় উদাসীন, তার আর পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক করছি।

বাবা এখন অশীতিপর। মনে মনে ভাবি, বাবা হতে গেলে কত কষ্ট আর পরিশ্রমই না করতে হয়। জানি না, নীরবে কত চোখের পানি ফেলেছেন বাবা। হয়তো আর কিছুদিন পর আমাদের পরিবারে সুদিন ফিরবে। কিন্তু তার কতটা দেখে যেতে পারবেন বাবা?